শিউলি ফুল
সৌ মে ন্দ্র লা হি ড়ী
সৌ মে ন্দ্র লা হি ড়ী
“একটু জল খেলে ভাল হতো , গ্লাসের
দিকে হাত বাড়াতেই হাতের কাঁপুনিতে গ্লাসটা পড়ে ঠং ঠং আওয়াজ করে গড়িয়ে গেল।
অসহ্য যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে, জানলার ওপাশে
শিউলি গাছ অসংখ্য ফুল নিয়ে হাসছে”।
সূর্যের আলো পুরোপুরি নিভে আসার আগেই বাড়ীটা পুরো খালি হয়ে গেল।
যদিও কয়েকদিন আগেই খালি হয়ে গেছে, তবু লোকজন থাকায় গমগম করছিল। একটা চেয়ার নিয়ে
ছোট্ট উঠানে বসেছিলাম। এখনও প্যান্ডেলটা খোলেনি, কাল
খুলবে।একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বসেছিলাম, আজ
আর বারণ করার কেউ নেই।
সন্ধ্যা বেলায় এক কাপ চা খাওয়ার অভ্যাস । নেশাটা বেশ চাগাড়
দিলো,উঠে ঘরে গেলাম। রান্না করার লোকটাকে আজ বেশ কয়েকদিন
ছুটে দেওয়া আছে। নিজেই চা করতে গেলাম ,এর আগে বহুবার
করেছি , অভ্যাস বসে দুকাপ জল নিয়ে ফেললাম , না আর লাগবে না। এককাপ জল ফেলে দিলাম। চা নিয়ে ঘরে গেলাম । ঘরে এখনও
রজনীগন্ধা গন্ধ ছড়াচ্ছে। ইজি চেয়ার টেনে সুমিতার মুখোমুখি বসলাম । সুমিতা মালা
লাগান দামী ফ্রেমের ওপারে, মাত্র তেরোদিন আগে আমায় একা
করে এবাড়ী শূন্য করে চলে গেছে।আজ মৎস্যমুখী সেরে শোভন তার ফ্যামিলি নিয়ে চলে
গেছে।
পাশের ঘরে একটা আওয়াজ পেতে উঠে গিয়ে দেখি জানলার একটা পাল্লা খুলে
ঝুলছে । কোনরকমে দড়ি দিয়ে বাঁধলাম। যখন এই দুকামরার
বাড়ি করে ঢুকি তখন মেয়ে শিপ্রার বয়স ছয় আর ছেলে শোভনের তিন। তারপর থেকে আর
বাড়ীতে হাত দেওয়া হয়নি।কতবার চেষ্টা করেছি বাড়ীটা বাড়াব একটু মেরামত করব
সুমিতা করতে দেয়নি, বলছে এভাবে টাকা খরচ করো না, ছেলেমেয়ে দুটো
মানুষ করতে হবে,পড়াশোনা করাতে হবে। এখন তো পড়াশোনায় কত
খরচ।
আবার ইজিচেয়ারটায় বসলাম। ছেলেমেয়ে দুটো শিক্ষিত হয়েছে বড় চাকরি
করে।শিপ্রা তো স্বামী পুত্র নিয়ে বিদেশে থাকে, শুনেছি ওখানে নাকি বড় চাকরি করে।
সুমিতার বারবার ডাকা সত্ত্বেও গত তিন বছরে একবারও আসেনি অযথা এতগুলো খরচ হয়ে যাবে
বলে। সুমিতা চলে যাওয়ার পরেও আসেনি, দুঃখের সাথে অনেক
টাকা পাঠিয়েছে।
রাত বাড়ছে,
খিদে খিদে লাগছে, না কিছু তৈরী নেই,
চাল আলু আছে , একটু ফুটিয়ে নিলে হতো,
কিন্তু ইচ্ছে হলো না।একটা মিষ্টির বাক্স পেলাম , সুগার ধরা পড়ার পর সুমিতা একটাও খেতে দেয়নি, আজ আর বাধা দেবার কেউ নেই, দুটো সন্দেশ খেয়ে
জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম । সুমিতা প্রায় বলত দেখো তোমার ছেলে এই বাড়ীটা একদিন কত
বড় করবে। এই বাড়ীটা শোভনের কাছে ছোট আর দমবন্ধ করা লাগল। একটা আলিশান ফ্ল্যাট
কিনে চলে গেল।সমস্ত পুরনো জিনিস বাতিল করে নতুন জিনিস দিয়ে সাজাল ।আমার আর
সুমিতার জায়গা হলো না, আমরা অনেক পুরনো বলে বাতিল
জিনিসের সাথে রয়ে গেলাম এই বাড়ীতে। শোভন চলে যাবার পর সুমিতা ভেঙে পড়ে, যদিও মুখে বলত ভালই হয়েছে , ওরা ভালো থাকুক,
আমরা বুড়োবুড়ি ঠিক থাকব,বলতে বলতে মুখ
ঘুরিয়ে নিতো, যাতে চোখের সিক্ত কোল দেখতে না পাই।
ঘুম আসছে না, সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি
হলেও একটা গুমোট গরম লাগছে , শরীরটা কেমন অস্হির লাগছে ।
উঠে বসলাম , জল খেলাম, আস্তে
আস্তে উঠে জানলা খুলে দিলাম, দমকা একটা হাওয়া ঢুকল ঘরে।
শিউলি ফুলের গন্ধে ম ম করছে।তাকিয়ে দেখি সামনের গাছটা ফুলে ভরে আছে, নীচটাও ফুলে সাদা হয়ে আছে, শরৎ এসে গেল।
সুমিতা খুব শিউলি ফুল ভালবাসতো। আমি তুলে এনে দিতাম , সুমিতা
একটা রেকাবে সাজিয়ে রাখত, গন্ধ সারাদিন ছড়িয়ে থাকত।
সুমিতার ফোটোর দিকে নজর গেল,বললাম সকালে এনে দেব। শরীরটা
আরো খারাপ লাগছে বাহাত আর বুকের বা পাশে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে । ইজিচেয়ারে বসে
পড়লাম, নিজেই বুকে হাত বুলাতে লাগলাম ।সুমিতার ফোটোর
পাশে দেওয়ালে বেশ কিছুটা জায়গা আছে , ওটা আমার জন্য ,
বুঝতে পারছি ওটা ভরতে বেশী সময় লাগবে না। যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে,
সুমিতা এত কষ্ট তুমি সইলে আর আমাকে একটু বুঝতে দাওনি। তুমি
চিন্তা করতে তুমি আগে চলে আমার কি হবে? তোমায় আর চিন্তা
করতে হবে না।
একটু জল খেলে ভাল হতো , গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতেই হাতের কাঁপুনিতে
গ্লাসটা পড়ে ঠং ঠং আওয়াজ করে গড়িয়ে গেল। অসহ্য যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সারা
শরীরে, জানলার ওপাশে শিউলি গাছ অসংখ্য ফুল নিয়ে হাসছে। একবার
আমায় শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করতে হবে।কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়লাম, দরজা খুলে শিউলি
গাছের দিকে যেতে থাকলাম, এটুকু রাস্তা যেন শেষ হচ্ছে না,
যে ভাবেই হোক সুমিতাকে শেষ বারের জন্য শিউলি ফুল দেব।
সকালে একটা ফোন হলো- '' অসীম কাকু মারা গেছেন, সম্ভবত
হার্টফেল, মৃতদেহ আপনাদের শিউলি গাছের নিচে পড়েছিল,
আর হাতের মুঠোতে ছিল অনেক শিউলি ফুল''।
0 comments:
Post a Comment