Thursday, December 25, 2014

গ্রন্থ আলোচনা


সোনালি মুখার্জি-র পায়ে পায়ে প
আলোচনায় শিখা মাইতি

কৈশোর পেলব, পথ চলার শুরু। প্রাণের সাথে কলমেরও পথ চলা শুরু। যত এগোয়, কলম তত বুঝতে পারে জীবনই আসলে লম্বা একটা পথ। কখনও মদির তো কখনও পাণ্ডুর। তবে পিলসুজের শিখা স্থির জ্বালিয়ে রাখা চাই। এসব নিয়ে ‘প’ পুপু সোনালির পদাবলি। কবি বলছে, “শরীর অমৃত পাক/এমন অভিশাপ যেন ছোঁয় না আমায়।/স্বপ্নকে অমৃত দাও/রং, গন্ধ, তাল, ছন্দ, দোলা--/সুরের সুতীব্র নেশা--/ঘিরে থাক। ডুবে যাক প্রাণ।“.....ফুরোয় না পদাবলী/আলো ধারাপাত।“ 

সোনালি আদিতে পুপুসোনালি। পেশায় চিকিৎসক, নেশা শব্দ দিয়ে নকশা আঁকা। বাবা-মায়ের হাত ধরে ‘বিদ্যার্থী রঞ্জন’-এ শুরু। তারপর ক্লাস নোটের পাতায়, সাংসারিক হিসেবের পাতায়, এখন চেম্বারে রুগী দেখার ফাঁকে প্রেসক্রিপশন প্যাডে। এসব নিয়ে ‘প’। কবির কথায়, “দুপুর/পুপুর মেঘলা দুপুর/সোনার রঙে ছোঁয়া-/বইয়ের পাতায় মনের খাতায়।/চোখের জলে ধোয়া।“............”সোনার সুতো, রুপোর সুতো/মুক্তো-মানিক গাঁথা।/দুপুর বেলার আলোর খাতাই/গপ্পো লেখার পাতা।“ 

“মনের আয়না টুকরো করে/ছিটিয়ে দিলাম/মেজেতে”.....”ধুলোয় ছড়িয়ে দিয়ে খেলি আমি/আলো-আগুন খেলা।“........”অদ্ভুত সে রূপটি তাহার/ দেখতে/আমি-ই একমাত্র/নিদাঘ চোখে/জাগি।“... ৪৫টি কবিতা নিয়ে সোনালি মুখার্জির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প’। কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থটি তিনটি বিভাগে ভাগ করেছেন। নাম দিয়েছেন খুন খারাপি, সাংসারিক এবং সর্বশেষ অভিমন্যু। 

খুন খারাপি বিভাগে রয়েছে আটটি কবিতা। এই বিভাগের প্রথম তিনটি কবিতা ‘মৈত্রেয়ী’, ‘পুপুর দুপুর’ এবং ‘আগুন খেলা’ থেকে কয়েকটি পংক্তি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি কবিতার মধ্যে অদ্ভুত ভাবে জায়গা করে নিয়েছে কার্ফু, বিদ্রোহ, ক্রুশ, রক্তাক্ত পেরেক, অপাপবিদ্ধ, মৃত্যুর জাল প্রভৃতি গভীর অর্থবহনকারী শব্দ। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন এই বিভাগের নাম খুন খারাপি? পুপুর পদাবলীতে খুন খারাপির জায়গা কোথায়? পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কৈশোরেই কবি যেন আত্মস্থ হয়েছেন নির্মম বাস্তববোধে। নাহলে কি করে বলা যায়, “আমি বিশ্বাসী সহজ পথের ধারে/চলবে না কোনও আমলাতন্ত্রকারী।/যে রাজার নীচে বিদ্রোহ শুরু হয়/গেরুয়া রঙের উত্তরী খানা তারই। অথবা ক্রুশের লম্বা ছায়া, কাঁটার মুকুট/রক্তাক্ত পেরেকের আতঙ্ক থেকে/পালাতে পালাতে পালাতে.../জোরে দুই চোখ বন্ধ বুজে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে/বললে/”চিনি না, চিনি না!!!/এ আমার কেউ নয়....”

এই বিভাগের শেষ কবিতায় আসি। কবিতার নাম ‘আগুনপদ্ম’। কবি বলছেন, “ব্যথা, দুঃখ, ক্ষোভের সাগর/মেয়েমানুষ জানে।/সেই আগুনকে চোখের জলেই/ডোবায় চোরাটানে।“... বলছেন, “আগুন ঝরে পদ্ম-চোখে/

মেয়েমানুষ নয়/কন্যাকে সে মানুষ করবে/সেইখানে তার জয়”...”মুচড়ে ভাঙে সমাজ তাকে।/ছিঁড়তে থাকে পাতা/জ্বলতে জ্বলতে সর্বজয়া”....”দেখত সমাজ, দেখল শহর/জ্বলন্ত সেই 


শিখা/হাজার মেয়ে ‘মানুষ’ করতে/অগ্নি দীপলিকা।“ নিখাদ বাস্তব চেতনা। শুরুতেই পরিণত মনস্কতা। 
এমন যার শুরু সে তো বলবেই, “আমি আগুনকে শুধু পুজো করি সারা সময়/আমি ফিনিক্সকে শুধু বুকের ভিতর রাখি।..”(সাংসারিক বিভাগের প্রথম কবিতা ফিনিক্স-এক প্রথম দুই লাইন)
কবি এখন সংসারী। তাঁর “স্বপ্ন ভাঙে।/টুকরো আশার ছড়িয়ে থাকে/এদিক ওদিক/ফুলের তোড়ায় শুকনো পাতা/ধুলোয় চাপা 
হাসির ঝিলিক...” মমতারও জায়গা আছে। “এলো খোঁপায় পাখির বাসা/চোখে কালির কাজল টানা/কোলের পাশে ভালোবাসার/ছোট্ট শরীর দিচ্ছে হানা!/নরম নরম হাতের মুঠো/বুকের কাছে ফোকলা হাসি-/বিনা কথায় বলবে, তোমায়/কত্তখানি ভালবাসি।” 

আবার এলো স্বপ্ন। …“পাখি আবার স্বপ্ন দেখতে থাকল।/ভারী ডানা টেনে টেনে প্রাণপণ/বেঁচে থাকতে থাকতে, স্বপ্ন দেখতে থাকল.../...ছোট্ট বাসাটা, নরম পালক আর/পাটের ফেঁসোর মাঝে গোল আরামের ওম/নিশ্চিন্ত সবুজ গাছের ছায়া...” 

এত দিনে বেশ কিছু কবিতা লেখা হয়ে গেছে। এবার একটু আত্মস্মরণ, অনুপ্রেরণা কোথায়? মনে পড়ছে, ….”বাবা-মার প্রশ্রয় ছিল।/তাঁরাও ভালো বাসতেন লোকটিকে/তা ছাড়া আমার স্কুল।/নব নালন্দাষ/সেখানে তো এই রবি ঠাকুর ছাড়া/অন্য কোনও ঠাকুরের পুজোই হয় না।“..... 

অনেকটা পথ এগিয়েছ কবি। এবার একটু মেলে ধর নিজেকে।.....”ঠোঁটে মজা।/চোখে হাসি। কে বলে কাল/হরণ করে সকল মধু মাস?/তুমি তুমি-ই।/সেই তো প্রাণ।ফাগুয়া দোল।/রং বাহার, রাসের রসোচ্ছ্বাস।“ 

কাজ কাজ আর কাজ। সংসারী আর ডাক্তারি। সাথে কবিতা। তারপর কি? কেন “সারাদিন কাজকর্মের পর/একটু ফাঁক পেলে ভালোবাসতে বসি।/সব সময় গুছিয়ে বসতে পারি না।/হয়তো তাড়াতাড়িতে দু-চারটে আদর----/কখনও একটু সময় হাতে থাকলে/আরাম করে শুয়ে/ভালোবাসায় ডুব দেওয়া যায়।/কখনও একেবারেই সময় হয় না।“.... কবি অনর্গল, সরল। তা না হলে অকপট স্বীকারোক্তির এমন শব্দডালিকে কবিতায় বলা যায় ‘পুজো আচ্চা’। 

হ্যাঁ, এই হল ‘প’। কবি-চিকিৎসক সোনালি মুখার্জির প্রথম কবিতার বই। প্রচ্ছদেও ‘প’। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন, সপ্তর্ষি প্রকাশন, ৫১ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা - ৭০০ ০০৯। বিনিময় মূল্য ৬০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা ও শহরতলির সব পুস্তক বিপণিতে।


0 comments:

Post a Comment