Thursday, December 25, 2014

প্রবন্ধ ১

কবিতাই মানুষের কথা
অরূপম মাইতি

কার্যত বিধ্বস্ত কবি এরপর চলে যান প্যারিস। তারপর প্যারিস থেকে লন্ডন। লন্ডনে থাকতে কবি, প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন ফ্রন্ট, আলজেরিয়ার আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট, সাউথ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী বিরোধী আন্দোলন, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।


-আপনি না কলেজের অধ্যাপক? ছেলে-ছোকরাদের ফিচলেমিতে কেন নিজেকে জড়ালেন? 

-ছেলে-ছোকরারা অসামাজিক কাজ করেছে কি? করেনি! তবে হ্যাঁ, এদের লেখাকে যেভাবে অশ্লীল এবং অসামাজিক বলে চিহ্নিত করবার চেষ্টা চলছে, সেটা আমি মানতে রাজি নই। 

কলকাতা পুলিশের দুঁদে পুলিশ কমিশনার পি কে সেন তাঁর ধমকানির উত্তরে এমন স্পষ্ট ভাষণ শুনতে তৈরি ছিলেন না। কবিরা সমাজ বদলাতে পারে না ঠিকই, তবে সমাজের অবস্থানকে তার লেখায় তুলে ধরতে পারে আর সেই লেখা সমাজকে দিশা নির্দিষ্ট করতে সাহায্য করে। ১৯৬২-৬৪ সাল। সারা বাংলা জুড়ে একটা অস্থির পরিস্থিতি। সেই সময়ে সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, দেবী রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল, সন্দীপন তাঁদের লেখা দিয়ে এমনই একটা কাজ করছিলেন, যাকে হাংরি আন্দোলন বলা হয়। এই আন্দোলন কোন সংগঠিত আন্দোলন ছিল না। নিয়ন্ত্রণের অভাব যেমন ছিল, প্রকাশও বিক্ষিপ্ত। 

সমীর রায়চৌধুরীর চাইবাসার বাড়িতে আড্ডা বসত। আমার এই লেখা যাকে নিয়ে, সেই কবি তখন সদ্য বি এ পাশ করেছেন আশুতোষ কলেজ থেকে। চাকরির সন্ধান করতে করতে হঠাৎ সুযোগ এসে যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওলজিতে অনার্স নিয়ে পড়ার। জিওলজি পড়ার সুবাদে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে চাইবাসায় আগমন। তারপর যথারীতি আড্ডা মারার লোভে সমীর রায়চৌধুরীর বাড়ি। সুনীল, শক্তি, সন্দীপনের সঙ্গে তরুণ কবিও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। এম এস সি পড়া শেষের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আশুতোষ কলেজে প্রভাষকের চাকরি। প্রশাসন তখন চাইছে আন্দোলন ভাঙতে। কলকাতা পুলিশের কর্তারা কবি-সাহিত্যিকদের বেছে বেছে পুলিশের সদর দপ্তরে ডেকে এনে হেনস্থা করছেন। তরুণ কবিও বাদ যাননি। সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও পরে আবার ডাক পড়ে। মহামান্য আদালতের কাছে বলপূর্বক রীতিমত বলতে বাধ্য করা হয় যে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কবি-সাহিত্যিকরা অসামাজিক কর্মে লিপ্ত, তারা অপরাধী। জনৈক কবিও আর চাপ সহ্য করতে পারেননি। আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি জবানবন্দী দিলেন।

 -আমি অবিবাহিত, আমার বয়স ২৮ বছর। বর্তমানে আমি ২৩ রয়েড স্ট্রীটে থাকি। আমি জিওলজিতে এম এস সি এবং আশুতোষ কলেজের প্রভাষক। ১৯৬২ সনে বা তার কাছাকাছি কোন এক সময়ে হাংরি পুস্তিকা আমার চোখে পড়ে। আমি সাহিত্য আন্দোলনে আগ্রহী ছিলাম। পরে আমি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত হই। যদিও তার বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরীকে আমি আগে থেকে চিনতাম। কলেজ স্ট্রীট কফি হাউস এই আন্দোলনকারীদের আড্ডা মারার জায়গা। কিছুকালের মধ্যে হাংরি আন্দোলনের অন্যান্য শরিক যেমন শৈলেশ্বর, সুভাষ, দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের অনুরোধে বিভিন্ন সময়ে হাংরি পুস্তিকায় গদ্য ও কবিতা লিখেছি। কোথা থেকে ছাপানো হত, আর কে তার খরচ যোগাতো আমি জানি না। ১৯৬৪ সনে গ্রীষ্মে মলয় পাটনা থেকে কলকাতা আসে ও আমাকে প্রকাশিতব্য পুস্তিকার জন্য লেখা দিতে বলে। আমি কুসংস্কার নামে একটা লেখার পাণ্ডুলিপি ব্যক্তিগতভাবে মলয়কে দিই। তারপর আমি দুমাসের জন্যে ডালহৌসি চলে যাই এবং কলকাতা ফিরে আমি আলোচ্য পুস্তিকাটি দেখতে পাই। পরে ডাকযোগে একটা কপি পেয়েছি। আমার মতে মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় নিদারুণ বিরক্তি ও অসম্ভাব্যতার উপলব্ধি থাকে। আমি মনে করি তাদের সাহিত্য আন্দোলন নৈতিকভাবে কলুষিত হয়ে গেছে এবং আমি হাংরি আন্দোলন থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছি। 

এইভাবে কবিকুলকে নিয়ে যখন টানাহ্যাঁচড়া চলছে, তখন আমেরিকার বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে কয়েক জন কবির ছবি সহ হাংরি আন্দোলন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি আশুতোষ কলেজ কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি তৈরি করেন। 



সেই কমিটির সুপারিশে কলেজের প্রভাষকের চাকরি থেকে তরুণ কবিকে অপসারিত করা হয়। কার্যত বিধ্বস্ত কবি এরপর চলে যান প্যারিস। তারপর প্যারিস থেকে লন্ডন। লন্ডনে থাকতে কবি, প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন ফ্রন্ট, আলজেরিয়ার আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট, সাউথ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী বিরোধী আন্দোলন, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিও করতেন। 

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, কলকাতার কবির বিদেশে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিল জীবিকার সন্ধান। কলকাতায় থাকতে কবিতা ও অন্যান্য লেখার জন্য যে কবিকে হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, লন্ডনে থাকতে সেই কবি ছিলেন কবিতা থেকে অনেক দূরে। এই শহরে থাকতে আলাপ হয় সান্ত্বনা দেবীর সঙ্গে। তিনিও তখন লন্ডনে চাকরি করছেন। দুজনে মিলে সংসার পাতলেন নর্থ লন্ডনের ৩৬ হিলফিল্ড অ্যাভিন্যুতে। কবিতার জগত থেকে অনেক দূরে ঘোর সংসারী কবি তখন জীবন কাটাচ্ছেন পরম আনন্দে। সময় পেলেই তাঁর ছোট্ট গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন ঘুরতে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ভাল লাগলে, গাড়িতে রাখা ছোট্ট তাঁবু বের করে সেখানেই আস্তানা গেড়ে ফেলছেন।

তবে একজন স্বভাব কবি কত দিনই বা পারেন কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে। বিদেশের মায়াও ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছিল। সাথে সাথে নিভৃতে অন্তরালে কলমের গতিও ছিল অবিরত। ১৯৭৮ সনে কলকাতা ফিরে যোগ দিলেন চিত্রবাণী পত্রিকায়। চিত্রবাণী প্রকাশিত হত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষামূলক গবেষণা কেন্দ্র থেকে। এই গবেষণা কেন্দ্রটি পরে ইউ জি সি অধীনে চলে যায়। পরবর্তী কালে কবি সেখানে পূর্বাঞ্চলের অধিকর্তার পদে আসীন হন। প্রায় একই সময়ে কবি ন্যাশনাল বুক এজেন্সির উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। যে সময় কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর উদ্যোগে কবির লেখা, দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, সে সময় কবির লেখা পূর্বাশা পত্রিকাতেও ঠাঁই করে নিয়েছে। চোদ্দ বছরের ব্যবধানে, লন্ডন থেকে কলকাতায় ফিরে কবি দেখলেন তাঁর প্রায় সব কৃত্তিবাসী বন্ধুই সংবাদ মাধ্যমে বেশ ভাল ভাল জায়গায় কর্মরত। এমন একটা অবস্থা যে লেখা পাঠালেই, প্রকাশ মোটামুটি নিশ্চিত। তবে কবি সে পথ মাড়ালেন না। 

কবি আছেন সব কিছুতে, আবার কোন কিছুতেই নেই। ঘুরে বেড়ান আপন খেয়ালে। লিখতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। সমসাময়িক বন্ধুকবিদের মত তাঁর স্তাবককুল নেই। সব কিছুই যেন কেমন একটা ঔদাসীন্যে ভরা। বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায় লেখা ছাপানোর আগ্রহ নেই। লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর জগত। তারাই দায় নেয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের। লিটল ম্যাগাজিনই তাঁকে পুরস্কৃত করে। তাঁর কথায়, “মানুষের প্রবণতাই হচ্ছে, আত্মপ্রকাশ করা। সে তাই কবিতা লেখে, কবিতা লিখেই আত্মপ্রকাশের চর্চা করতে থাকে। আত্মপ্রকাশের প্রবণতা না থাকলে হয়ত মানুষ আর কবিতা লিখবে না। কিন্তু আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা কি কোন দিন থেমে যেতে পারে?” ২০১১ সনে সপ্তর্ষি থেকে প্রকাশিত ‘পিয়া মন ভাবে’, তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থের জন্য আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে সাহিত্য আকাদেমির এক অনুষ্ঠানে কবি উৎপল কুমার বসুর হাতে তুলে দেওয়া হবে এ বছরের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ২০১৪।


0 comments:

Post a Comment