বাড়ি ফিরতে রোজই রাত হয়। লাস্ট ট্রেনে তারই মত
সহযাত্রী থাকে কজন। রোজ এক সাথে গেলে যেমন হয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে একটা। কোন রাতে কেউ না এলে একজন
না একজন কথাটা তুলবেই- সমর দা কে দেখছি না। বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে বলতে হয় না। উত্তর টা যার কাছে থাকে
সে ঠিক বলে দেয়- গতকাল বলছিল ছেলের শরীরটা খারাপ। সবাই জেনে যায় সমরের
ছেলের জ্বর। প্রতিরাতে ওরা তাস খেলে। রামি। বাজি রেখেই খেলা হয়। পরিমাণ নগণ্য। তবুও । ওদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী তাপস। অদ্ভুত ভাবে প্রায়
প্রতিদিনই জেতে।
হাতের তাসগুলোর মধ্যে হরতনের বাদশাটার কোন জোড়
নেই। সেটাই ফেলে দিতে চাইছিল তাপস। ফেলতে গিয়েও মনে হল
হেমন্ত এটা খাবে। হরতনের বাদশার বদলে রুইতনের নহলাটা ফেলতে গিয়ে সে বলে- সমরদার
ছেলেটা অনেক দিন ধরে ভুগছে। ভালো ডাক্তার দেখাচ্ছে না কেন। সমরের সঙ্গে একই ষ্টেশনে
নামে হারাধন সমাজপতি। সে বলল- আজ নিয়ে গেছে বাকুড়ায়। ছেলটার না হেভী বুদ্ধি। মাধ্যমিকে ৮৯ শতাংশ নম্বর
পেয়েছিল। -আরে সে তো সবাই জানে। মিষ্টি খাওয়াল না সমর দা সেবার। তাপস বলে উঠে। এই দলের মধ্যে কেউ জানেনা
তাপসও মাধ্যমিকে ৭৮ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল। পরের বাড়ি কাজ করা মায়ের সাধ্য ছিল না আর পড়ানোর। সুতরাং লাল সবুজ পলিথিনে
মোড়া লজেন্স নিয়ে ট্রেনের কামরায় শুরু হল অন্য জীবন। সেও প্রায় আট বছর হয়ে গেল। অকারণ বিষণ্ণতায় ভরে যায়
তাপসের মন। ভুল করে হরতনের বাদশা ফেলে দেয় সে। ক্ষিপ্র গতিতে হেমন্ত
বাদশাকে তুলে নেয়। এবং ডিক্লেয়ার করে। পরের ষ্টেশন এসে যায়। হারাধন নামছে। তাপস মুখ বাড়িয়ে বলে- ছেলেটার খবর টা নিয়ো দাদা।
কদিন পরের কথা। রাতের শেষ লোকালের সাত
নম্বর কামরার পরিবেশ বিষণ্ণ। রামি খেলাও বন্ধ। আসলে একটা খারাপ খবর এসেছে। সমরের ছেলের লিউকেমিয়া ধরা পড়েছে। সবাই চুপ করে বসে। ওরা কেউ কারো আত্মীয় নয়। প্রতিবেশীও নয়। শুধুই রাতের শেষ লোকালের
সহযাত্রী। একটার পর একটা ষ্টেশন পার হচ্ছে । - ডাক্তার বলেছে ভেলোরে
নিয়ে যেতে। নীরবতা ভেঙে বলল হারাধন। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর হেমন্ত বলল- সে তো অনেক খরচের ব্যাপার। -আমরা কি কিছু সাহায্য
করতে পারব না,
তাপস বলে ওঠে- আর কিছু না হোক আমরা এতদিন ধরে সহযাত্রী।
কিন্তু আমরা কি ভাবে
...মানে তুই তো জানিস তাপস, হারাধন বলে- কত টুকুই বা রোজগার আমাদের...,হা হা কারের মতই শোনায় তার গলা।
-কি বলো হারাধান দা! অত ছোট ভাবো কেন নিজেদের। এসো আমরা একটা যৌথ ফান্ড গড়েতুলি, শুরুটা না হয় আমিই করবো
পনের হাজার টাকা দিয়ে। তোমরা তোমাদের সাধ্যমত দেবে।-পনের হাজার! এত টাকা তুই কোথায় পাবি?- হেমন্ত শুধোয়।
-আরে হেমন্ত দা, এতদিন তোমরা রামিতে কতটাকা হেরেছো আমার কাছে খেয়াল আছে? সব জেতা টাকা আমি জমিয়ে রেখেছি,বলে যায় তাপস- একটা ভালো
কাজে লাগাবো বলে। এটা কি ভালো কাজ নয়!
তার গলাটা একটুও কাঁপছিল না। মুখটা একটু চকচক করছিল
হেমন্তের কেন কে জানে মনে হচ্ছিল কোন হরতনের বাদশা ওদের সামনে বসে আছে।
0 comments:
Post a Comment