ভালবাসা সবুজ ও সাহিত্য
২০১৪ বিশ্বকাপ এখন শেষ লগ্নে। কোয়ার্টার ফাইনাল
সদ্য সমাপ্ত। সেমিফাইনাল লাইনআপ তৈরি। নতুন বিশ্বকাপ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দেশকে, আর কয়েক দিনের মধ্যে বিশ্ববাসী পেয়ে যাবে। সামনের মঙ্গল আর
বুধবার সেমিফাইনাল। আগামী রবিবার খেলা শেষের পরে সোনার বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে
চ্যাম্পিয়নের শিরোপা মাথায় স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করবে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দল।
বিশতম বিশ্বকাপ শুরুর প্রথম দিন থেকে বেশ কয়েকটি দেশ তাদের
দীর্ঘ দিনের ফুটবল ঐতিহ্য,
বিশ্ব ফুটবলে তাদের এযাবৎ কালের কৃতিত্ব
এবং প্রবাদপ্রতিম ফুটবলারদের জন্য বিশ্বমানসে সমাদৃত। মাসাধিক কাল ধরে
চলতে থাকা বিশ্বকাপ ফুটবলে,
সারা পৃথিবীর মানুষ বুঝি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা,
জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি-কে চেনার চেষ্টা করেছে পেলে, মারাদোনা,
রুমেনিগে, প্লাতিনি, পাওলো রোসিকে স্মরণ করে। ঠিক এই সময়ে একটা
কথা মনে আসে।
শুধু গ্যারিঞ্চা-কাকা-রোনাল্দিনহো দিয়ে
কেন বিশ্ব ব্রাজিলকে চিনবে? ব্রাজিলকে তো মানুষ পাওলো কোহেলোর দেশ বলেও জানে। আর্জেন্টিনা মানে
কি শুধুই কেম্পেস-বাতিস্তুতা-রিকেলমে, আর্জেন্টিনা কি
জর্জ লুই বর্গেসের দেশ নয়? বিশ্বের কাছে ফ্রান্সের পরিচয় কি শুধুই জিদান-রিবেইরি-বেঞ্জিমা। ফ্রান্স বলতে কি
ভলতেয়ার, আলেক্সান্ডার ডুমা, ভিক্টর হুগো, শার্ল বোদলেয়ার বা আলবেয়ার কামু নয়? ইতালি দেশে কি শুধু ডিনো জফ, রবার্টো ভাজ্জিও
বা ফাবিও কানাভারো জন্ম নিয়েছে? লুইগি পিরানদেলো(নোবেল প্রাইজ ১৯৩৪), সালভাতোর কোয়াশিমোদো (নোবেল প্রাইজ, ১৯৫৯)বা ডারিও ফো-এর (নোবেল প্রাইজ ১৯৯৭) মত বিশ্ববরেণ্য
লেখকও তো ইতালি দেশটাতে জন্ম নিয়েছিলেন।
সাউথ আমেরিকার কয়েকটি দেশ এবারের বিশ্বকাপে উচ্চ পর্যায়ের
ফুটবল শৈলী প্রদর্শন করেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যেমন চিলি গ্রুপ লিগ থেকে পরের
রাউন্ড, প্রি কোয়ার্টার-ফাইনালে পৌঁছেছিল। কলম্বিয়া
কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে ব্রাজিলের কাছে হেরে বিশ্ব কাপ থেকে ছিটকে গেলেও জেমস
রডরিগেজ, ছয়টি গোল করে ২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবলে সোনার বুটের সবথেকে
জোরালো দাবিদার।
দেশের নাম চিলি। চিলির ফুটবল মানে
অ্যালেক্সি স্যানচেজ, ভিদাল,
ভার্গাস। অত্যন্ত প্রতিভাসম্পন্ন
গোলকিপার ক্লদিও
ব্রাভোকেও কি বাদ দেওয়া যায়। চিলি এমন একটি দেশ, যে দেশের নাম উচ্চারণ করলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে পাবলো নেরুদা এবং
গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের কথা। দুজনেই নোবেল পেয়েছিলেন। সেই পাবলো নেরুদা, বিশ্বকবির লেখায় যাঁর কবিতা প্রভূত সম্পৃক্ত হয়ে উঠেছিল। একটু বিশদে আলোচনা
করা যাক।
১৯১২ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিজে গীতাঞ্জলির অনুবাদ করলেন। ভূমিকা লিখে দিলেন ডব্লিউ বি ইয়েটস। বিশ্বকবির সাহিত্যকীর্তি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করলেন আন্দ্রে
গিদে। পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করলেন বরিস পাস্তারনাক ও আনে
আখমাতোভা। জন্মসূত্রে আমেরিকান ভাবী স্ত্রী জেনোবিয়া কাম্প্রুবির
সহায়তায়, ১৯৫৬ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ বিজেতা বিশিষ্ট স্প্যানিশ
কবি জুয়ান রামন জিমিনেজ পরের পাঁচ বছরে বিশ্বকবির বাইশটি গ্রন্থ স্প্যানিশ ভাষায়
অনুবাদ করলেন। স্প্যানিশ এবং লাতিন আমেরিকান সাহিত্য সেই সময়ে
রবীন্দ্রসাহিত্য দ্বারা প্রভূত প্রভাবিত হয়। উল্লেখযোগ্য রূপে এই প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল বিখ্যাত
মেক্সিকান কবি অক্টাভিও পাজ,
পাবলো নেরুদা এবং গ্যাব্রিয়েল
মিস্ত্রালের লেখায়।
তবে এই সব সাহিত্যিকের মধ্যে প্রবাদপ্রতিম চিলিয়ান কবি
পাবলো নেরুদার মধ্যে রবীন্দ্রপ্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল, সব থেকে বেশি। ‘বাইশটি প্রেমের কবিতা এবং একটি হতাশার গান’ নামে নেরুদার একটি গ্রন্থ কবিকে খ্যাতির চূড়ান্ত সীমায়
পৌঁছে দেয়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বইটির বিক্রি ছাড়িয়ে যায় দশ
লক্ষাধিক কপি। তবে বইটির সঙ্গে বিতর্কও জড়িয়ে ছিল। আর সেখানেও
উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভালোদিয়া তেইতিলবোয়েম নামে এক চিলিয়ান কবি আবিষ্কার করেন, কাব্যগ্রন্থের ১৬তম কবিতাটি বিশ্বকবির একটি কাব্যগ্রন্থের
৩০তম কবিতার হুবহু নকল। এই সাহিত্যচৌর্যের জন্য নেরুদাকে প্রচুর সমালোচনার মুখে
পড়তে হয়েছিল। বন্ধু জোয়াকিন সিফুয়েন্টেস সেপভেদা বারণ করা সত্বেও পাবলো এ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারেননি। পরবর্তীকালে নিজের
স্মৃতিকথায় নেরুদা এই অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
কলম্বিয়া দেশটির নাম শুনলে ফুটবল
অনুরাগীদের মনে পড়বে কার্লোস ভালদোরামা, রাদামেল ফালকাও, রেনে হিগুইতা বা আন্দ্রে এসকোবারকে। একই সঙ্গে
সাহিত্যানুরাগীদের মনে পড়বে ইভেলিও রোজারো, ল্যরা রেস্ত্রেপো, জুয়ান গ্যাব্রিয়েল বা জর্জ আইজ্যাকসের কথা। তবে সব থেকে বেশি
মনে পড়বে বুঝি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজের কথা। ১৯৮২ সালে
সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ বিজেতা এই প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক মাত্র কিছু দিন আগে, গত ১৭ই এপ্রিল ২০১৪ তারিখে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর
বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি তাঁর মৃত্যুকে এক মহানতম কলম্বিয়ানের
মৃত্যু বলে অভিহিত করেন। ম্যাজিক রিয়্যালিজম সমৃদ্ধ তাঁর উপন্যাস ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড’ লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে একটা জোয়ার নিয়ে এসেছিল। ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর অসামান্য উপন্যাস ‘মেমোরিজ অফ মাই মেলাঙ্কোলি হোরস’-এর রেশ সাহিত্যুানারাগীরা এখনও ভুলতে পেরেছেন কিনা, সন্দেহ আছে।
II২II
এ তো গেল দেশ, তার ফুটবল এবং তার
সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। বিশ্বসাহিত্যে এমন অনেক লেখক আছেন, সাহিত্যের বাইরে যারা ছিলেন একান্ত ফুটবলপ্রেমি। আলবেয়ার কামুর কথা ধরা যাক। যিনি ছিলেন একাধারে পেশাদার ফুটবলার এবং সাহিত্যিক। সাহিত্যে অবদানের
জন্য ১৯৫৭ সালে নোবেল পুরস্কার বিজেকা। কৈশোরে কামু রেসিং অ্যালজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে গোলরক্ষক
হিসেবে উত্তর আফ্রিকান চ্যাম্পিয়ন কাপে খেলেছিলেন। ফুটবলকে নিয়ে তার
একটি জনপ্রিয় উক্তি— ‘আমি ফুটবলের কাছে ঋণী, কারণ নৈতিকতা ও
বাধ্যবাধকতা বলতে আমি যা শিখেছি তা ফুটবলের কাছ থেকেই পাওয়া।’ সে সময় কামুর এই উক্তিটি বিভিন্ন টি-শার্ট ও ফুটবল পোস্টারে
লেখা থাকতো।
জ্যঁ পল সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০), অস্তিত্ববাদী এই ফরাসি দার্শনিক ও লেখক ছিলেন ফুটবলের একজন
অনুগত সতীর্থ। তার রচিত ‘ক্রিটিক অব ডায়ালেক্টিক্যাল রিজন’ বইটিতে তিনি হ্যারি রেডনাপের কথার মন্তব্যে বলেছিলেন— ‘ফুটবলের মাঠে বিপরীত পক্ষের
উপস্থিতিতে সবকিছুই জটিল হয়ে যায়।’
স্যার আর্থার কোনান ডয়েল (১৮৫৯-১৯৩০), বিখ্যাত গোয়েন্দা কাহিনী ‘শার্লক হোমস’ এর লেখক। তিনিও ছিলেন
একজন দক্ষ ফুটবল খেলোয়াড়। সাউথ সিতে
থাকাকালীন তিনি সিউডোনিম এসি স্মিথের তত্ত্বাবধানে পোর্টসমাউথ অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল
ক্লাবের গোলরক্ষক হিসেবে খেলতেন। এমনকি কোনান একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারও ছিলেন। তিনি মেলবোর্ন
ক্রিকেট ক্লাবের পক্ষে প্রথম শ্রেণীর দশটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলেন।
অ্যানথনি বার্জেস(১৯১৭-১৯৯৩), ‘ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ বইয়ের লেখক। তিনিও ছিলেন
ফুটবলের একজন ভক্ত। ফুটবলকে উদ্দেশ্য করে তিনি একটি উক্তি করেন— ‘সপ্তাহের পাঁচদিন কাজের জন্য, সপ্তম দিন
প্রার্থনা করার জন্য, আর ষষ্ঠদিন শুধুমাত্র ফুটবলের জন্য।’ ফুটবলপ্রেমীর এই লেখকের রয়েছে ফুটবল খেলা নিয়ে নানা ধরনের
রচনা।
নিক হর্নবি, ব্রিটিশ লেখক, একজন আদ্যন্ত ফুটবলপ্রেমী আর এই প্রেমের বশেই ফুটবল নিয়ে তিনি লেখেন ‘ফিভার পিচ’ বইটি। পরবর্তীকালে এই বইয়ের কাহিনী নিয়ে একটি সফল চলচ্চিত্র
নির্মিত হয়।
রডি ডাওয়েল, আইরিশ লেখক। বিখ্যাত বই ‘দি কমিটমেন্ট’। ১৯৬৭ সালে লীগ কাপ
ফাইনালে চেলসি যখন টমি ডোচার্টির তত্ত্বাবধানে ছিল তখন থেকেই তিনি চেলসি’র সাপোর্টার। রডি ডাওয়েল তার বন্ধুকে বলেছিলেন ‘আমি ফাইনাল খেলাটি আমার বাবার সঙ্গে দেখছিলাম, আমার বয়স তখন আট অথবা নয়। সেদিন চেলসির খেলা
আমার মন কেড়ে নিল, আর তখন থেকে আমি চেলসিকে সাপোর্ট করা শুরু করলাম।’
‘১৯৮৪’ এবং ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম-এর লেখক, প্রাবন্ধিক জর্জ
অরওয়েল (১৯০৩-১৯৫০) ফুটবলকে বর্ণনা করেছেন ‘বিউটিফুল গেম’ হিসেবে। ‘দ্য স্পোর্টিং স্পিরিট’-এ তিনি জাতীয়তাবোধ
এবং ফুটবলকে এক করে দেখান। তিনি লেখেন—
‘তুমি যদি তোমার অসুস্থ উদ্দেশ্য হাসিলের
জন্য বিরাট তহবিল জোগাড় করতে চাও, তাহলে তুমি তা সফলভাবেই করতে পারবে ইহুদী-আরব, জার্মান-চেক, ভারতীয়-ব্রিটিশ, রাশিয়া-পোলিশ, ইতালি-যুগোস্নাভিয়ার মধ্যে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করে। প্রত্যেক খেলায়
পাওয়া যাবে লক্ষাধিক দর্শক…ফুটবল ন্যায়ের জন্য তেমন কিছুই করতে পারে না।’
সালমান রুশদি নিজেকে টটেনহামের একনিষ্ঠ
একজন ভক্ত হিসেবেই পরিচয় দেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ‘দ্য পিপলস গেমস, দ্য অ্যাডুকেশন অব সকার ফ্যান’ শিরোনামে আট পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ লেখেন বিখ্যাত ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকায়।
জুলিয়ান বার্নস, ২০১১ সালের ম্যান বুকার পুরস্কার বিজয়ী এই লেখক আজীবন
লেইস্টার সিটি ফুটবল দলের ভক্ত ছিলেন। ২০০১ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন— ‘লেস্টারশেয়ার হল আমার শৈশব।’ ১৯৯৬ সালের স্টিভ ক্লারিজ ও ক্রিস্টাল প্যালেসের মধ্যে
ম্যাচটি ছিল তার জন্য স্মরনীয়।
II৩II
২০০৮ ইউরোপিয়ান কাপের আগে জার্মান
পত্রিকা স্পিগেলকে দেওয়া বিশ্ববন্দিত তুর্কীশ সাহিত্যিক অরহান পামুকের একটি
সাক্ষাৎকার থেকে ফুটবল এবং সাহিত্যের মধ্যে তৈরি হওয়া অটুট ভালবাসার কিছু নমুনা
পাওয়া যায়।
প্রশ্নঃ আপনি নিজে কি ফুটবল খেলতেন?
পামুক: কোন ক্লাবের হয়ে নয়, স্কুল ছুটির আগে পরে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় ফুটবল খেলেছি।
প্রশ্ন: আপনি কি ভালো খেলতেন?
পামুক: এ প্রশ্নে আমি বেশি বিনয়ী হতে চাই
না। খেলায় আমার মেধা ছিল, কিন্তু আমি কখনই
পেশিবহুল মানুষ ছিলাম না। খেলার থেকে বেশি খেলা নিয়ে কল্পনার ফানুস ওড়ানো আমার কাছে
ছিল বেশি প্রিয়। ছোটবেলার এসব
ফ্যান্টাসি মানুষের জীবনের ধরণটা ঠিক করে দেয়। সেসব ফ্যান্টাসিতে আমি ছিলাম একজন ফুটবল হিরো। আমার দিবাস্বপ্নের
মধ্যে একটি দৃশ্যের কথা বলি। ইউরোপিয়ান কাপে আমাদের ফেনেরবাচে ক্লাব খেলছে আর আমার মতো
একটা শিশুকে ৮৯তম মিনিটে মাঠে নামানো হয়েছে। আর যে একমাত্র গোলে আমাদের ক্লাব জিতেছে, সেটা আমিই দিয়েছি।
প্রশ্ন: আপনার সাহিত্যকর্মে ফুটবল নিয়ে
কিছু লেখার কথা ভাবছেন?
পামুক: আমার লেখার মধ্যে যদি তুরস্ক হেরে
যায় তাহলে সেটা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রাচীন আমলে গ্রিকরা যেভাবে মঞ্চ-নাটক দেখত, ঠিক সেরকম স্টেডিয়াম হচ্ছে একটি মঞ্চ, যেখানে ফুটবলের নাটক প্রদর্শিত হয়। ফুটবল দেখার বিষয়
আর সাহিত্য বলার।
তাছাড়া সাংবাদিকের চোখ দিয়ে দেখাটা আমার
পছন্দের নয়, যেমন ফুটবলে মাফিয়াদের সম্পৃক্ততা। এ ধরনের বিষয় আমার ভালো লাগে না। আমার পছন্দের
রূপকথার গল্পে ফুটবল কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, তা আমার জানতে
ইচ্ছে করে না। ১৯৯০-এ প্রকাশিত আমার উপন্যাস 'দ্য বস্ন্যাক বুক'-এ এই বিষয়ে একটি
ভূমিকা থাকার কথা ছিল। গল্পের একটি চরিত্র তার স্ত্রীর খোঁজে ইস্তাম্বুল চষে
বেড়াচ্ছে। আমার উপন্যাসের প্রথম খসড়ায় লোকটি রেডিওতে শুনছে, তুরস্ক ফুটবলে ইংল্যান্ডের কাছে মার খাচ্ছে। একটার পর একটা গোল খেয়ে চলেছে। আশির দশকে তুরস্ক
নিজের মাঠে বাছাই পর্বের দুটি খেলায় ইংল্যান্ডের কাছে ৮-০ গোলে হেরেছে। ইংরেজ খেলোয়াড়রা
মাঠে আমাদের খেলোয়াড়দের টিটকারি দিয়েছে। সে দেশের পত্রিকায় আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে এই বলে যে, এরকম একটি ম্যাচ খেলার মতো সত্যিকারের সবুজ মাঠ ইস্তাম্বুলে
নেই। আমার কাছে এই পরাজয় দেশের সামগ্রিক অবস্থার একটি অপমানজনক
আলঙ্কারিক বিবরণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি এই অংশগুলো উপন্যাস থেকে বাদ দিয়েছি। এখন অনুতাপ হচ্ছে।
অরহান পামুক দেখিয়েছেন, ফুটবলে পরাজয় থেকে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হয়। ক্রমশ তা উগ্র জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়। পরিবর্তে অন্য
জাতিকে হেয় চোখে দেখতে থাকে।
ফুটবল এবং সাহিত্যের মধ্যে এই প্রেমের
সম্পর্ক আগামী দিনে, আশা করা যায় আরও দৃঢ় হবে। কারণ, ফুটবলে যে সৃষ্টিশীলতা আর শৈল্পিক রূপকল্প আছে, তা কোন অংশে সাহিত্যের থেকে কম নয়। একটি সাধারণ মানুষ
থেকে তারকা ফুটবলার হয়ে ওঠার কাহিনী কোন অংশে একটি আলোড়নসৃষ্টিকারী উপন্যাসের
থেকে কম নয়। একটা দেশকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গড়ে তোলার কাহিনী কোন অংশে
একটি মহাকাব্যের থেকে কম নয়। ফুটবল মানুষকে সব দেয়। তার গরিমা, তার দর্প,
তার অহংকার, নীতি,
জাতীয়তাবোধ, নেতৃত্ব,
শোষনের বিরুদ্ধে রুখে ওঠা সব, সব কিছু। এখানেই তো ফুটবল সাহিত্যের পরিপূরক।
0 comments:
Post a Comment